অনেক দিন আগের ঘটনা। মাস্টার্স পাস করে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম। তো একবার ঢাকায় একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশন এ এসে পৌঁছালাম রাত ৯টায়। ট্রেন আসবে রাত ১১টায়। ঝড়-বৃষ্টির রাত, তাই একটু আগেই চলে আসলাম। কারণ ঝড়-বৃষ্টির রাতে অনেক সময় যানবাহন পাওয়া যায় না। শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশন থেকেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেব।
কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছিল, তাই রেলস্টেশনে মানুষের আনাগোনা কম। ওয়েটিং রুমে কিছু সংখ্যক যাত্রী বসে আছে। ওয়েটিং রুমে এ ঢুকতে ইচ্ছা করল না। অনেক পুরানো রেলস্টেশন, তাই ওয়েটিং রুমটা খুব একটা পরিচ্ছন্ন না। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর একটা ছোট চায়ের দোকান চোখে পড়ল। একজন বৃদ্ধ লোক চা-বিস্কুট বিক্রি করছেন। দু-চারজন লোক দোকানের সামনে চা পান করতে করতে আড্ডা দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছিল, তাই একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। ভাবলাম, এক কাপ চা পান করা যেতে পারে। দোকানের সামনে গিয়ে দোকানদারকে বললাম, "চাচা, আমাকে এক কাপ চা দিন।" চা পান করা শেষ হলে প্ল্যাটফর্মে হাঁটা শুরু করলাম। রেলস্টেশনটা অনেক পুরানো, তবে প্ল্যাটফর্মটি অনেক লম্বা। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে শেষ মাথায় চলে আসলাম। এখানে কোনো লাইট নেই, তাই এই কর্নারটি কিছুটা অন্ধকার। দূরের একটা বৈদ্যুতিক বাতি থেকে সামান্য আলো আসছে। একটা পুরানো বেঞ্চ চোখে পড়ল। ওই বেঞ্চটাতে আমার হ্যান্ডব্যাগটা রেখে বসে পড়লাম।
রাত তখন প্রায় ১০টা বাজে। ট্রেন আসতে এখনও এক ঘণ্টা বাকি। বসে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে ঝিমাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা মেয়েলি কণ্ঠ শুনে একটু চমকিত হয়ে উপরে তাকালাম। মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "এখানে একটু বসতে পারি?" আমি এক পলক মেয়েটির দিকে তাকালাম। মেয়েটি একটা লাল শাড়ি পরেছে। মেয়েটির গায়ের রঙ অস্বাভাবিক ফরসা। চোখ দুটো কোন কারণে লাল হয়ে আছে। আমি মেয়েটিকে বললাম, "জি, বসতে পারেন।" আমি কিছুটা অবাক হলাম, মেয়েটি ওয়েটিং রুমে না বসে এই অন্ধকারে একজন অচেনা লোকের সাথে এসে বসেছে কেন। তাছাড়া সাথে কোনো ব্যাগও নেই। ট্রেনের যাত্রী হলে তো সাথে ব্যাগ থাকার কথা।
আড়চোখে লক্ষ্য করলাম, তার হাতে একটা লাল জবা ফুল। আমার গা টা কেন জানি ছমছম করছিল, একটু অস্বস্তি লাগছিল। যদিও ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। হয়ত অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি জায়গায় একটা অচেনা মেয়ের পাশে বসে আছি, এজন্য হয়ত এরকমটা লাগছে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আমি নীরবতা ভাঙলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি কি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন?" মেয়েটি আমার দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল, "জি।" আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কোথায় যাবেন?" মেয়েটি মুখে কিছুটা বিরক্তি ভাব নিয়ে বলল, "জানি না।" মেয়েটির মাথায় লাল সিঁদুর দেখে বুঝতে পারলাম, মেয়েটি বিবাহিত। আমি অনুমান করলাম, হয়ত স্বামীর সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে।
আমি তাকে বললাম, "কিছু মনে করবেন না, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টুকটাক ঝগড়া সবারই হয়। যদি এরকম কিছু হয়ে থাকে, তাহলে আপনার ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত।" মেয়েটি এবার আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। তার চোখ দুটো লাল দেখাচ্ছে। সে কথা বলতে শুরু করলো, "আপনার অনুমান সঠিক, তবে আমি আর ঘরে ফিরব না।" তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনাদের বিয়ের কত বছর হয়েছে?" সে বলল, "পাঁচ বছর।" আমি জানতে চাইলাম, "আপনার সন্তান আছে?" সে মুখে কিছু বলল না, তবে না সূচক মাথা নাড়ল।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আমি তাকে বললাম, "দেখুন, যদিও অপরিচিত হিসেবে আপনার ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার নাক গলানো উচিত না, তারপরও আপনার যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে আপনার সমস্যাটা আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন। আমি চেষ্টা করে দেখব, আপনাকে কোনো সমাধান দিতে পারি কিনা।" মেয়েটি একটা অবজ্ঞা সূচক হাসি দিল।
তারপর কথা বলতে শুরু করলো, "আমার নাম অর্পিতা। পাঁচ বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছে। লাভ ম্যারেজ। আমার স্বামীর সাথে বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আমার ভাইয়ের মেয়েকে সে পড়াতে আসত। সেখান থেকেই পরিচয়, এবং তারপরে প্রেম। আমরা একজন আরেকজনকে খুবই ভালোবাসতাম।" তারপর মেয়েটি একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে আবার কথা বলতে শুরু করলো, "ও বর্তমানে একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। বিয়ের পর বেশ ভালোই চলছিল আমাদের সংসার। ছুটির দিনে আমরা দুজন একসাথে ঘুরতে বেরুতাম। আমার শ্বশুর-শাশুড়িও আমাকে খুব আদর করত। আমার স্বামী ছিল তাদের একমাত্র ছেলে।
বছর দুই ভালোই চলছিল সব কিছু। তারপর আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমাদেরকে বাচ্চা নেয়ার জন্য চাপ দিতে লাগলেন। তারা বলতে লাগলেন, "আমাদের বয়স হয়েছে, কয়দিনই বা আর বাঁচবো। আমরা নাতি-নাতনির মুখ দেখে মরতে চাই, তাই তোমরা আর দেরি করোনা।" আমারও সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা একটা বাচ্চা নিব। কিন্তু আমি কোনোভাবেই কনসিভ করতে পারছিলাম না। ও আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনো প্রবলেম পেল না। দেখতে দেখতে চার বছর পার হয়ে গেল, কিন্তু আমাদের বাচ্চা হল না। এটা নিয়ে খুবই ডিপ্রেশনে পড়ে গেলাম।
আমাদের বাড়ির আঙিনায় একটি ফুলের বাগান আছে। বাগানটি আমার নিজের করা। আমি ফুল খুব পছন্দ করি। অবসর সময়ে বাগানে কাজ করে সময় কাটাতাম। কিন্তু ডিপ্রেশনের কারণে কোনো কিছুই আর ভালো লাগছিল না। এদিকে আমার শাশুড়িও বাচ্চা না হওয়ার কারণে আমার উপর দিন দিন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। বিভিন্ন সময় আমাকে খোঁচা দিয়ে বিভিন্ন কথা বলা শুরু করলেন। আগে আমার কোনো দোষ ধরতেন না। কিন্তু ইদানীং কথায় কথায় আমার দোষ ধরা শুরু করলেন। এমনকি আমার স্বামীর কাছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার নামে নালিশ করতে থাকলেন। যার কারণে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝির শুরু হতে থাকলো।
একদিন তরকারিতে লবণ কম হওয়ায় আমার শাশুড়ি আমার উপর রেগে গিয়ে আমাকে অনেক বাজে বাজে কথা শুনাতে লাগলেন। একপর্যায়ে তিনি বলতে লাগলেন, "আমার একটা মাত্র ছেলে, কত শখ করে বিয়ে দিয়েছিলাম, আজ ৫টা বছর হয়ে গেল, এখনও নাতি-নাতনির মুখ দেখতে পারলাম না। একটা অপয়া মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। এমন অপয়া মেয়ের বিশ খেয়ে মরা উচিত।" উনার কথা শুনতে শুনতে আমিও হঠাৎ রেগে গেলাম। রেগে গিয়ে উনাকে বললাম, "আপনার এত অশান্তি লাগলে আপনি বিশ খেয়ে মরেন।" আমার এ কথা শুনে আমার শাশুড়ি আমার উপর আরও রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে আমাকে বললেন, "তুমার এত বড় সাহস, তুমি আমাকে বিশ খেতে বল! আজ আসুক আমার ছেলে, হয় তুমি এ ঘরে থাকবে, নাহয় আমি থাকব।" আমার শাশুড়ির চিৎকার চেঁচামেচি সহ্য করতে না পেরে আমি আমার রুমে চলে গেলাম।
সন্ধ্যা ৭টায় আমার স্বামী বাড়ি ফিরলেন। প্রতিদিন আমি দরজা খুলে দিই। আজ আমার শাশুড়ি দরজা খুলে দিলেন। আমার স্বামী ঘরে ঢুকতেই আমার শাশুড়ি আমার নামে নানা রকম নালিশ করতে থাকলেন। আমি নাকি উনার সাথে বেয়াদবি করেছি, উনাকে গালাগালি করেছি, ইত্যাদি নানা কথা। আমার স্বামী আমাদের রুমে এসে ঢুকলেন। আমি বিছানায় বসা ছিলাম, ওকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম। আমার স্বামী রাগান্বিত হয়ে আমার কাছে এসে আমাকে বলল, "তুমি এসব কী শুরু করেছ, তোমার সমস্যা কী?" আমি বললাম, "তিনি আমার নামে মিথ্যে বলছেন, এগুলো সত্যি না।" এ কথা বলার সাথে সাথে আমার স্বামী আমার গালে একটা চড় মেরে বসল। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ও আমাকে বলল, "তোমার এত বড় সাহস, আমার মায়ের সাথে বেয়াদবি করেছ, আবার আমার মাকে মিথ্যুক বলছ! আমার মার সাথে যদি মানিয়ে চলতে না পার, তবে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।" আমি রুম থেকে বের হয়ে বসার ঘরে গিয়ে বসলাম।
অনেকক্ষণ কাঁদলাম। যে মানুষটা আমাকে এত ভালোবাসতো, সে আমাকে এভাবে আঘাত করবে, আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব। ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম, দূরে ট্রেন আসছে। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, "তারপর কী করলেন?" মেয়েটি ট্রেনের দিকে হাত দেখিয়ে বলল, "তারপর ঐযে..." এটা বলেই সে বেঞ্চ থেকে উঠে রেললাইনের দিকে দৌড় দিল। দৌড়ে গিয়ে রেললাইনের উপর উঠে, যেদিক থেকে ট্রেন আসছে, সেই দিকে দৌড়াতে শুরু করলো। তার এমন কাণ্ড দেখে আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম।
আমি বেঞ্চ থেকে উঠে, "অর্পিতা দাঁড়ান!" বলে চিৎকার করলাম। তারপর যেই আমি দৌড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম, অমনি খপ করে পিছন থেকে কে যেন আমার হাত চেপে ধরল। তাকিয়ে দেখলাম সেই বৃদ্ধ লোক, যার দুকানে বসে চা পান করেছিলাম। আমি বৃদ্ধকে বললাম, "হাত ছাড়েন, মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে।" বৃদ্ধ বলল, "কোন মেয়েটা?" ঐ যে ঐ মেয়েটা... বলেই আবার যখন রেললাইনের দিকে তাকালাম, তখন আমার নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি চেয়ে দেখলাম, রেললাইনের উপর মেয়েটা নেই। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। চোখের পলকে মেয়েটি যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। বৃদ্ধ আমাকে বলল, "আপনি কাকে খুঁজছেন?" আমি বললাম, "অর্পিতা নামের একটা মেয়ে একটু আগে রেললাইনের দিকে দৌড়ে গিয়ে রেললাইনের উপর উঠে গিয়েছিল। এখন তাকে আর কোথায় দেখতে পাচ্ছি না। এত তাড়াতাড়ি মেয়েটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেল?" তখন বৃদ্ধ লোকটি বলল, "আপনি শান্ত হয়ে বসেন," বলে আমাকে টেনে বেঞ্চে বসিয়ে দিল।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার সমস্ত শরীর ঘেমে গিয়েছিল। খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলাম। তারপর বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বলল, "আপনি শান্ত হোন। আপনার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পেরেছি। আসলে অর্পিতা নামের কোনো মেয়েকে আপনি দেখেননি। পুরোটাই ছিল আপনার দৃষ্টি ভ্রম।" বৃদ্ধের কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে যাবার মতো অবস্থা। আমি বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললাম, "তার মানে কী, বলতে চান আপনি?" বৃদ্ধ বলল, "আমি বিষয়টা আপনাকে খুলে বলছি।
তারপর বৃদ্ধ লোকটি বলতে শুরু করল, “আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে এই স্টেশনে অর্পিতা নামের একটা মেয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। লোকজন বলাবলি করে প্রায়ই নাকি ওই মেয়েকে স্টেশনে ঘুরাঘুরি করতে দেখা যায়। অনেকেই নাকি দেখেছে। তবে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। যাই হোক, যা কিছু হয়েছে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। ট্রেন চলে এসেছে, আপনি ট্রেনে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন, তা না হলে ট্রেন মিস করবেন। আমিও আমার দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যাচ্ছি—এই বলে বৃদ্ধ লোকটি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
আমি বেঞ্চ থেকে উঠে আস্তে আস্তে ট্রেনের দিকে এগোতে থাকলাম। আমার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে, পা দুটো যেন সামনে এগোতে চাইছে না। আমি ট্রেনে উঠে আমার সিটে বসলাম। আমার সিটটা ছিল জানালার পাশে। জানালা দিয়ে যে বেঞ্চটাতে এতক্ষণ বসেছিলাম, সেই বেঞ্চটার দিকে চোখ পড়তেই আমার দম আটকে যাবার মতো অবস্থা হলো। দূর থেকে খুব স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছিল বেঞ্চের ওপর একটা লাল জবা ফুল পড়ে আছে—যে জবা ফুলটা ওই মেয়েটার হাতে ছিল। আমি চোখ দুটো বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসলাম। ট্রেন চলতে শুরু করল...।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন