আমার নাম রকিব চৌধুরী। একটা বেসরকারি এনজিওতে চাকরি করি। এনজিওটি একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের প্রতিষ্ঠানের শাখা রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষকে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করা, অর্থাৎ কৃষিকাজ বা খামারে কীভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অধিক উৎপাদন করা যায়, সে বিষয়ে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া।

Bangla Horror Story


যেহেতু গ্রামের বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকদের নিয়ে আমাদের কাজ, তাই আমাদের প্রতিষ্ঠানের সব শাখা গ্রামগঞ্জের আশেপাশে বা গ্রামের ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে। আমার কাজ হচ্ছে প্রত্যেকটি শাখায় গিয়ে এনজিও কর্মীদের কাজ পরিদর্শন করা। আমাদের প্রত্যেকটি শাখায় এনজিও কর্মীদের থাকার জন্য একটি কোয়ার্টারের ব্যবস্থা থাকে। পরিদর্শন করতে গেলে দুই-এক দিন কোয়ার্টারে থাকতে হয়। তো একবার গোপালপুর নামক একটি জায়গায় আমাদের একটি শাখার কাজ পরিদর্শন করতে গিয়ে আমার একটি ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই ঘটনাই আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।


যেদিন আমি গোপালপুর পরিদর্শনে যাই, সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল পৌঁছাতে পৌঁছাতে। সারা দিন বৃষ্টি হচ্ছিল এবং তখনও ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাদের গোপালপুর শাখাটি ছিল গ্রামের ভেতরে। বাস থেকে নেমে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বৃষ্টি থাকায় ছাতাটি মাথার ওপরে ধরে হাঁটছিলাম। আমাদের গোপালপুর শাখাটি গ্রামের ভেতর একটি পুরোনো দোতলা বাড়ি ভাড়া করে স্থাপন করা হয়েছিল। বাড়ির মালিক দেশের বাইরে থাকেন। কেয়ারটেকারের মাধ্যমে আমাদের এনজিওর জন্য এটি ভাড়া নেওয়া হয়।

যখন আমাদের অফিস, অর্থাৎ ঐ দোতলা বাড়িতে পৌঁছালাম, তখন দেখলাম পুরো বাড়িটাই অন্ধকার। খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ ছিল না। বাড়ির বারান্দায় উঠে মোবাইলের টর্চ অন করলাম। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কোথাও কোনো শব্দ নেই। অফিসের পিওন আমাকে এগিয়ে আনার কথা ছিল, কিন্তু হয়তো খারাপ আবহাওয়ার কারণে আসতে পারেনি।

কিছুক্ষণ বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করলাম। কারো কোনো সাড়া শব্দ পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম, অফিসের ম্যানেজারকে ফোন করি। ঠিক তখনই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামছে বলে অনুভব করলাম। মোবাইলের টর্চের আলো ফেলে দেখলাম, একজন বৃদ্ধ লোক সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। লোকটি খুব শুকনা, কুঁজো হয়ে হাঁটছে, পরনে হালকা হলুদ রঙের পুরোনো ফতুয়া এবং ধুতি।

লোকটি কাছে এসে বলল, "আপনি চলে এসেছেন, স্যার। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।"
লোকটির কণ্ঠ ভারী এবং কর্কশ। সে পরিচয় দিল, "আমি এই বাড়ির কেয়ারটেকার, আমার নাম শ্যামল দত্ত।"
আমি অবাক হয়ে গেলাম, এই অন্ধকারে লোকটি কীভাবে কোনো আলো ছাড়াই দোতলা থেকে নিচে নামল! আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমাদের অফিসের লোকজন কোথায়?"
সে বলল, "সবাই কাজ শেষ করে চলে গেছে। এখানে কেউ থাকে না।"

আমি বেশ অবাক হলাম। অফিসে কোয়ার্টার থাকা সত্ত্বেও এনজিও কর্মীরা বাইরে থাকে কেন? মনে মনে ভাবলাম, হয়তো তাদের পরিবার আছে, তাই তারা কোয়ার্টারে থাকে না।

বৃদ্ধ লোকটি বলল, "আসুন স্যার, আপনার থাকার ঘর দেখিয়ে দেই।"
সে উল্টো ঘুরে সিঁড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। আমিও তার পেছন পেছন দোতলায় উঠে গেলাম। বৃদ্ধ লোকটি একটা রুমের দরজা খুলে দিল। আমি ব্যাগ থেকে চার্জার লাইট বের করে অন করলাম এবং তার সঙ্গে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলাম।

লোকটি বলল, "আপনি হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিন, আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি।"
সে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

রুমটি খুবই পুরোনো। দেওয়ালের রঙ উঠে গেছে। তেমন কোনো আসবাব নেই—একটা পুরোনো খাট, একটা ছোট টেবিল, একটা চেয়ার আর কাপড় রাখার জন্য একটা আলনা। বাইরে তখনো প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে, বিদ্যুৎ নেই, চারপাশে শুধুই অন্ধকার। চার্জার লাইটের আলোয় আমি ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে চেঞ্জ করলাম এবং বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এলাম। রুমের ভেতর বেশ গরম লাগছিল, তাই জানালাটা খুলে দিলাম। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাইরে বৃষ্টি দেখলাম, তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। যাত্রার ধকলের কারণে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, বুঝতে পারিনি।

হঠাৎ ঘুমের মাঝেই অনুভব করলাম, আমার মুখের ওপর গরম বাতাস পড়ছে। পুরো শরীরের ওপর যেন কেউ চেপে ধরেছে! ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখলাম, সেই বৃদ্ধ লোকটি খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো লাল, ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ভয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলাম।

সে বলল, "স্যার, টেবিলে আপনার খাবার রেখেছি। খেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়বেন। জানালাটাও বন্ধ করে দিন। রাতে জানালা খোলা রাখা ঠিক না। আমি পাশের ঘরেই আছি, কোনো দরকার হলে ডাক দেবেন।"

এই বলে লোকটি রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি তড়িঘড়ি করে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলাম। লোকটাকে দেখে কেন জানি খুব ভয় লাগছিল। যদিও সে বৃদ্ধ, তবুও তার চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাগছিল।

টেবিলে রাখা খাবার ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। দুই-এক লোকমা খেয়েই উঠে পড়লাম। জানালাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আসছিল না।

সকালে দরজায় ধাক্কার শব্দে ঘুম ভাঙল। দরজা খুলতেই দেখলাম, একজন মাঝবয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, "স্যার, দুঃখিত। আমি জানতাম না আপনি আসবেন। আমি পাশের গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। ঝড়বৃষ্টির কারণে ফিরতে পারিনি।"

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি কে?"
সে বলল, "আমি এই বাড়ির কেয়ারটেকার।"

আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম, "তাহলে শ্যামল দত্ত কে?"
লোকটি বিস্মিত হয়ে বলল, "শ্যামল দত্ত তো ১০ বছর আগে মারা গেছে!"

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তাহলে কাল রাতে যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে কে ছিল?


আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, শ্যামল দত্ত কীভাবে মারা গিয়েছিল, আর সে এই বাড়িতে কী কাজ করত। তখন লোকটি কথা বলতে শুরু করল। লোকটি বলল, শ্যামল দত্ত এই বাড়ির কেয়ারটেকার ছিল। একদিন এক ঝড়ের রাতে ছাদের উপর থেকে পড়ে মারা যায়। ছাদের উপর কোনো কাজে হয়তো উঠেছিল। বৃষ্টির কারণে ছাদ পিচ্ছিল ছিল এবং ছাদে কোনো রেলিং ছিল না। তাই সবার ধারণা, পা পিছলে ছাদ থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে কারো কারো ধারণা, তাকে জিন-ভূত ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে।

রাতের বেলা তার হাতে একটা টর্চ লাইট আর একটা খাটের সাইজের লাঠি থাকত। সে যেদিন মারা যায়, সেদিন ছাদের ঠিক মাঝখানে তার টর্চ লাইট এবং হাতে থাকা লাঠিটা পাওয়া যায়। সে যদি ছাদ থেকে পা পিছলে পড়ে যেত, তাহলে তো তার টর্চ লাইট আর লাঠিটা ছাদের কিনারায় পাওয়া যাওয়ার কথা! এজন্য কেউ কেউ সন্দেহ করেন যে, তাকে হয়তো জিন-ভূত ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু স্যার, আপনি তার নাম জানলেন কীভাবে? লোকটির কথা শুনে আমি ঘামতে শুরু করলাম। আমার বেশ অস্বস্তি লাগছিল।

হঠাৎ যখন টেবিলের উপর চোখ পড়ল, তখন আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। টেবিলটা পুরো খালি! কাল রাতের থালা-বাসনগুলো টেবিলের উপর নেই। এগুলো কে সরাল? আমি তো দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে শুয়েছিলাম! তাছাড়া আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি ঘুমানোর আগে জানালাটাও বন্ধ করেছিলাম। জানালাটা কে খুলে দিল? আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। বিছানায় গিয়ে বসে পড়লাম। আমার গলা শুকিয়ে গেছে। আমি কেয়ারটেকারকে এক গ্লাস পানি আনতে বললাম। কেয়ারটেকার পানি আনার জন্য রুম থেকে বের হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারছি, আমাদের অফিসের স্টাফরা কেন এখানে থাকে না। নিশ্চয় তারা কিছু টের পেয়েছে! আমি হতভম্ব হয়ে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন