একদিন রবিন নামের এক যুবক একটি পুরানো শহরে এসে পৌঁছাল। শহরের চারপাশে প্রাচীন ভবন, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট এবং কিছুটা নিঃসঙ্গ পরিবেশ তাকে আকর্ষণ করেছিল। সে জানত না, এই শহরটি তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ের মুহূর্তগুলোর কারণ হয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে।
শহরের একটি পুরাতন তিনতলা বাড়ির ছাদের উপর একটি কক্ষ ভাড়া করে সে থাকতে শুরু করল। একদিন রাতে সে বিছানায় শুয়ে ছিল; নতুন জায়গা, তাই ঘুম আসছিল না। হঠাৎ সে নূপুরের আওয়াজ শুনতে পেল। কেউ যেন নূপুর পায়ে দিয়ে ছাদের উপর হাঁটছে। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত তখন ২টা বাজে। সে চিন্তায় পড়ে গেল, এত রাতে ছাদের উপর কে হাঁটাহাঁটি করছে।
সে তার কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারল না। সে দরজা খুলে বাইরে বের হল। বাইরে বের হতেই তার চোখে পড়ল, ছাদের কিনারায় নীল শাড়ি পরা একটি মেয়ে তার উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার নড়াচড়া পেয়ে মেয়েটি পিছন ফিরে তাকাল। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে এসে রবিনের সামনে এসে দাঁড়াল।
রবিন মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটি খুবই রূপবতী। তার চোখে একটি মায়া আছে। এবার মেয়েটি কথা বলতে শুরু করল। মেয়েটি বলল, "কিছু মনে করবেন না, আমি বোধহয় আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।" রবিন বলল, "না না, ঠিক আছে, আমি জাগ্রতই ছিলাম। নতুন জায়গা, তাই ঘুম আসছিল না।" মেয়েটি বলল, "আমার নাম শিলা। আমি রাতের বেলা ছাদে হাঁটতে বেশ পছন্দ করি।"
রবিন ভাবল, হয়তো এই বিল্ডিংয়ের কোনো ফ্ল্যাটে মেয়েটি থাকে। তারপর মেয়েটি আবার উল্টো ঘুরে ছাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল। রবিনও মেয়েটির পিছন পিছন গিয়ে ছাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল। তারপর তাদের মধ্যে কিছুক্ষণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হল। এরপর প্রতি রাতেই ছাদের উপর রবিন এবং শিলা সময় কাটাতে থাকল।
শিলা ছিল খুবই শান্ত স্বভাবের এবং মায়াবী। মাঝে মাঝে রবিনের কাছে শিলার কথাবার্তা বেশ অদ্ভুত মনে হত। শিলা যে কিভাবে রবিনের এত কাছাকাছি চলে এসেছিল, রবিন তা বুঝতে পারেনি। একদিন শিলা রবিনকে বলল, "আমি চাই তুমি শুধু আমার হবে।" রবিন শিলাকে কী বলবে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু রবিনের হৃদয়ে তার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করছিল।
রবিন বুঝতে পারল, সেও মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। একদিন শিলা রবিনকে বলল, "আমি তোমাকে আমার খুব প্রিয় একটি জায়গার ঠিকানা বলে দিচ্ছি। কাল তুমি সেই ঠিকানায় চলে এসো। আমি কাল রাতে তোমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করব।" পরের দিন রাতে রবিন খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে কী করবে বুঝতে পারছিল না। তারপর সে চিন্তা করল, যেহেতু সে শিলাকে ভালোবেসে ফেলেছে, তাই তার যাওয়া উচিত। তা না হলে শিলা অনেক কষ্ট পাবে।
সে গভীর রাতে শিলার দেওয়া ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা হল। শিলা একটি জঙ্গলের কথা বলেছে। সেই জঙ্গলের ভিতর নাকি একটি বাড়ি আছে। সেখানেই শিলা তার সাথে দেখা করতে চায়। রবিন বুঝতে পারল না, এত জায়গা থাকতে শিলা জঙ্গলের ভিতর কেন দেখা করতে চায়। একটি অজানা আকর্ষণে রবিন সেই জঙ্গলের উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকল।
একসময় সে সেই জঙ্গলের কাছে এসে পৌঁছল। জঙ্গলের বিপরীত পাশে একটি বড় নদী। তারপর শিলার কথামতো একটি মাটির রাস্তা ধরে তার হাতে থাকা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটা শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে একসময় সেই বাড়ির সামনে এসে পৌঁছল। বাড়িটা অনেক পুরাতন এবং দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাড়িটা পরিত্যক্ত। এখন রবিন একটু ভয় পেয়ে গেল। সে মনে মনে চিন্তা করল, এত রাতে এই পরিত্যক্ত বাড়িতে কি তার আসা উচিত হয়েছে?
সে আস্তে আস্তে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর চারদিকে টর্চ লাইটের আলো ফেলে দেখতে লাগল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু বিভিন্ন ধরনের পোকা এবং পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। সে এবার সাহস করে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল। বাড়ির ভিতরে খুব বিশ্রী একটা গন্ধ এবং খুবই স্যাঁতসেঁতে একটা পরিবেশ। কিছু অব্যবহৃত পুরনো আসবাবপত্র এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। সে আস্তে আস্তে একটি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। টেবিলের উপর একটি পত্রিকা রাখা। পত্রিকার উপর ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে।
রবিন পত্রিকাটা হাতে নিয়ে একটু ঝেড়ে নিল। তারপর পত্রিকাটা টেবিলের উপর রেখে পত্রিকার উপর টর্চের আলো ফেলল। পত্রিকায় দেওয়া তারিখ দেখে সে বুঝতে পারল, এটা আজ থেকে ১০ বছর আগের পত্রিকা। পত্রিকার প্রথম পাতা উলটাতেই তার চোখ আটকে গেল। পত্রিকার ভিতরের পাতায় শিলার ছবি ছাপা হয়েছে এবং ছবির শিরোনামে লেখা আছে, "নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন নৃত্যশিল্পী শিলা"।
সে বিস্তারিত পড়ে জানতে পারল, শিলার লাশ তার আত্মীয়-স্বজনরা খুঁজে পায়নি। রবিন হতভম্ব হয়ে পড়ল। ভয়ে তার গা ছমছম করতে থাকল। সে ভাবতে থাকল, তাহলে এতদিন সে কার সাথে প্রেম করেছে? তবে কি শিলা মৃত? হঠাৎ ঘরের বাইরে নূপুরের শব্দ শুনে ভয়ে তার সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করল।
সে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। বাইরে বেরিয়ে দেখল, শিলা দাঁড়িয়ে আছে। আজকে শিলা একটি লাল শাড়ি পরেছে। রবিন ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল; তার হাত-পা অবশ হতে থাকল। শিলা আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে এসে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
তারপর শিলা কথা বলতে শুরু করল, "তুমি এসেছ, রবিন। অনেক দিন থেকে আমি বড় একা। এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গী হবে।" চারদিক থেকে একটি ধোঁয়ার কুণ্ডলী রবিন এবং শিলাকে ঘিরে ফেলল। শিলা তার হাত দুটি বাড়িয়ে রবিনের গলায় স্পর্শ করল। রবিন বুঝতে পারল, আস্তে আস্তে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং সে মারা যাচ্ছে। তবে কি শিলা রবিনকে তার জগতে নিয়ে যাচ্ছে অনন্তকাল প্রেম করার জন্য...
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন